Dx Story

 অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

দৃশ্যটার সাথে বহুদিনের পরিচয় নাজিমের, এটা সেই দৃশ্য যেটা নিজের রক্ত বদল করে নতুন রক্ত ভরে নিয়ে প্রতিনিয়ত ভুলতে চায় সে। এমনও হয়েছে অনেকবার, দিনে কততমবারের মতো মনে পড়েছে দৃশ্যটা গুনত একসময়—যতবার মনে পড়ত সাথে সাথে এটা মাথা থেকে সরানোর জন্য করেছে মেডিটেশন; ওয়েস্টার্ন ইয়োগার ধারা—গুরুবাদী চর্চা থেকে শুরু করে এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সাথে তাহাজ্জুদ পর্যন্ত রপ্ত করেছে। ভুলবার এই ধারাবাহিকতায় দিনে একবারে যখন নেমে এল দৃশ্যটা মনে পড়া, সেটা তাও বছর চারেকের একটা ফেজ—তারপর আর গুনত না সে। আজ কতবার মনে পড়ল এটা মনে রাখতে গিয়েই যেন ভোলা হচ্ছিল না আর। একসময় আর মনে পড়ত না। আর তখন থেকেই নিজের ভিতরের দানবটা কীভাবে পা থেকে মাথা অব্দি গিলে নিয়েছিল তাকে, সে সম্পর্কেও আর কোনো ধেয়ান রইল না তার।

আজ আবার দেড় বছর পর, একুশ বছর আগের দৃশ্যটা তরতাজা হয়ে গেল চোখের সামনে। বাড়ি ভরতি মানুষ, পুলিশ, উঠানে কাপড়ে ঢাকা লাশ আর মহিলাদের সুর করে কান্নার শব্দ, সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল নাজিমের। বাচ্চাটার বয়স চার কি পাঁচ–বাড়ির একমাত্র পুরুষটির বড় স্যান্ডেলগুলো পরে উঠানময় হাঁটাহাঁটি করছে। স্যান্ডেলগুলো চিনতে পারে নাজিম, আলামত হিসেবে এগুলো জব্দ করেছে পুলিশ; কোনো এক ফাঁকে এগুলো হাতে পেয়ে গেছে শিশুটি। বাবা যেহেতু লাশ হয়ে শুয়ে আছে, মা কাঁদছে, পুলিশ নানাজনকে জিজ্ঞাসাবাদে ব্যস্ত—শিশুটির দিকে কারোর নজর নেই। মাঘী শীতের সকালে একটা পাতলা শার্ট গায়ে, ন্যাংটা একটি শিশু আপন মনে হাঁটছে তার মৃত বাবার স্যান্ডেলগুলো পরে।নাজিম তার কানে কিছুই শুনছিল না আর, চোখে সেই শিশুটি ছাড়া আর কিছু দেখছিলও না, তবে মরাবাড়ির তীব্র গন্ধটা খুব লাগছিল নাকে; এটাই কি কুয়াশার গন্ধ? নাজিম সম্বিৎ ফিরে পেল যখন আকবর ভাই তাকে ঘরের পেছনে নিয়ে সপাটে একটা চড় দিল তার গালে, টিনের বেড়ায় ধরে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখল সে। আকবর ভাই দাঁত মুখ খিচিয়ে গালি দিল তাকে, শুয়োরের বাচ্চা! আবেগ মারানোর জায়গা পাস না? নাজিম খেয়াল করে তার চোখ গড়িয়ে পড়া পানিতে নাকমুখ ভেজা; সে কাঁদছিল বাবা হারানো শিশুটির আপন মনে হাঁটা দেখে! আকবর ভাই পকেট থেকে পাঁচশো টাকার একটা নোট বের করে নাজিমের হাতে পুরে দিতে দিতে বলে, এক্ষুনি তুই ঢাকা যাবি, পিছনে ফিরে তাকাবি না, মুরগি কোথাকার!

বাচ্চাটির বয়স এখন কত হবে? পঁচিশ বা ছাব্বিশ? তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী তন্বীর বড় দুই ভাইয়ের ছোটটার বয়স এমনই। খাবার টেবিলে প্লেট-চামচের শব্দ, আর ওর শ্বশুরবাড়ির সকল সদস্যের গল্প-গুজব নাজিমের কাছে স্তব্ধ হয়ে গেল–তন্বীর বড় ভাইয়ার চার বছরের ছেলে নাজিমের স্যান্ডেল পরে হাঁটছিল যখন। নাজিম একবার বাচ্চাটিকে আর আরেকবার দেখছিল তন্বীর ছোট ভাইয়া আহনাফকে। আহনাফের বয়সী হবে এখন ওই বাচ্চাটা, যার বাবা উঠানে লাশ হয়ে শুয়ে ছিল, যে বাচ্চাটা জানত না তার বাবা গত রাতে কাদের হাতে যেন জবাই হয়ে গেছে। ওইদিন বাসে চেপে যশোর ছেড়ে এসেছিল নাজিম ঠিকই, কিন্তু তার জীবন আটকে পড়েছিল সেদিনে, বা তার আগের রাতে। মাংস খেতে পারেনি কয়েক বছর, আজ আবার সেই দৃশ্যে—খাবার ছেড়ে সে উঠে গেল। শ্বশুরবাড়িতে প্রথম দাওয়াতে এসেছে সে। টেবিলে আস্ত খাসির রোস্ট। বাথরুমে গিয়ে বমি করে, চোরের মতো বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল নাজিম।

Comments

Popular posts from this blog

Dx STORY

Dx caption